দীর্ঘ ৪ যুগেও নেই পরিবর্তন: ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ নৌ-রুট

0 81

অনলাইন ডেস্ক:

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কম খরচে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের সহজ মাধ্যম মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথ। একদিকে জরাজীর্ণ ফিটনেস বিহীন লঞ্চ অন্যদিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক দিয়ে রয়েছে লঞ্চ চালানোর অভিযোগ।

দীর্ঘ ৪ যুগ পেরিয়ে গেলেও কোনো পরিবর্তন আসেনি এই নৌপথের যাতায়াত ব্যবস্থায়, সম্প্রতি ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার প্রবেশ মুখের বিভিন্ন পয়েন্টে যত্রতত্র কার্গো জাহাজ নোঙর করে রাখায় যাতায়াতে ঝুঁকি বেড়েছে বিগত বেশ কয়েক বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

বুধবার (২৩ মার্চ) সকাল থেকে সরেজমিনে ওই নৌপথ ভ্রমণ করে দেখা গেছে, দীর্ঘ দিনের পুরাতন জরাজীর্ণ ফিটনেস বিহীন অধিকাংশ লঞ্চ দিয়ে চলছে যাত্রী পারাপার। এতে প্রায়ই ঘটছে ছোট বড় নানা দুর্ঘটনা অভিযোগ যাত্রীদের। এতে ফলে সলিলসমাধি হয়েছে অসংখ্য মানুষের।

বিআইডব্লিউটিএ ও ঘাট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুবাদে মুন্সিগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় যাতায়াত করেন। সড়ক পথে যানজটের ভোগান্তি এড়াতে নদীপথে লঞ্চে মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এই অঞ্চলের মানুষ।

স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, জোড়া তালি আর মেরামত করেই বছরের পর বছর চলছে প্রতিটি লঞ্চ-আর ঝুঁকিপূর্ণ এসব লঞ্চ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে যাত্রীরা। তবে স্বল্প দূরত্বের গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথে যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে দীর্ঘ দিনেও উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

এই নৌপথের নিয়মিত লঞ্চযাত্রী আকবর হোসেন বলেন, একসময় এই নৌ-রুটটি নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে কাঠপট্টি ঘাট যেত। সেখান থেকে আব্দুল্লাপুর ঘাট ও বেতকা ঘাট হয়ে তালতলা ঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে কালের বিবর্তনে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ নৌ-রুটটি বন্ধের পথে।

এ নৌ-রুটের লঞ্চ চলাচলের সময় ঠিক নেই। বৃদ্ধি করা হয়েছে ভাড়া। তার উপরে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ক্লিংকারের ধোঁয়া ও যত্রতত্র জাহাজ নোঙর করে রাখা হয়। তাই অনেক যাত্রীই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এপথ ব্যবহার করা থেকে।

২০২১ সালের ৫ এপ্রিল এস.কে.এল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ সাবিত আল হাসান নামের একটি লঞ্চডুবে সলিলসমাধি হয় ৩৬ জনের। এরপর বছর না ঘুরতেই ২০২২ সালের ২০ মার্চ আরেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এরপর দুর্ঘটনা এড়াতে এই নৌ-রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটএ)। সে সময় নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, নিরাপদ নতুন নৌযান সংযুক্ত করে নৌপথটি পুনরায় সচল করা হবে। কিন্তু কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর পুরনো লঞ্চগুলোকেই চলাচলের জন্য ফের অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথটি পরিণত হয়েছে মরণ ফাঁদে।

বাবু শেখ নামের এক যাত্রী বলেন, বর্ষা মৌসুম আসলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বৈরী আবহাওয়ায় জরাজীর্ণ এসব লঞ্চ ও অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ। রোদ কিংবা বৃষ্টি, সামান্য আবহাওয়ার পরিবর্তন হলেই পাল্টে যায় এই নদীপথের দৃশ্যপট। উত্তাল ঢেউয়ের কাছে যেন অসহায় হয়ে পরে যাত্রীরা।

এ নৌ-রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন যাত্রীরা আরও বলছেন, যে কোনো সময় আবারও ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা।

রাজু মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, আমাকে প্রতিদিনই ব্যবসার কাজে মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে যেতে হয়। সড়ক পথে দীর্ঘ পথ ঘুরে যাওয়াসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ার কারণে ভোগান্তি এড়াতে লঞ্চে করেই কর্মস্থল থেকে আসা-যাওয়া করি। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এসব ফিটনেসবিহীন লঞ্চের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তবে জীবিকার তাগিদে আমাদের বাধ্য হয়েই এ পথে চলাচল করতে হয়। আর আমরা দেখতে পাচ্ছি অধিকাংশ লঞ্চের চালকই অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তাই এসব কারণেই আমাদের এই নৌ-রুটে যাতায়াতে ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ।

এসব লঞ্চে নিয়মিত যাতায়াতকারী আরেক যাত্রী ও বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সোলেমান হক বলেন, আমি প্রতিদিনই এই লঞ্চগুলো দিয়ে আসা-যাওয়া করি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্যস্থলে না পৌঁছায় বা ফিরে না আসি ততক্ষণ মানসিক দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকি কারণ এই নৌপথে যাতায়াতকারী প্রতিটি লঞ্চে থাকে অতিরিক্ত যাত্রী। কোনো কোনটিতে যাত্রীর চাপ কম থাকলে, কম সংখ্যক যাত্রী নেয়া হলেও অধিকাংশ লঞ্চেই প্রতিদিন নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী।

আরও বেশ কয়েকজন যাত্রী, সবুজ মিয়া, আক্তার হোসেন,রতন শেখসহ এক কলেজছাত্র হৃদয় সূত্রধর বলেন আমাদের প্রতিদিনই ব্যবসাসহ নানা কাজে মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ কিংবা ঢাকায় যেতে হয় কিন্তু সড়ক পথে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে আমরা লঞ্চেই বেশিরভাগ সময় যাতায়াত করে থাকি তবে এ রুটে লঞ্চ চলাচলের অবস্থা খুবই খারাপ, অধিকাংশ লঞ্চই ভাঙাচোরা আর বেশিরভাগ লঞ্চের-ই ফিটনেস নেই বলে আমরা জানি। তবুও সময় বাঁচাতে আমাদের বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে এসব লঞ্চে চলাচল করতে হচ্ছে।

ওই কলেজছাত্র আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে এইসব লঞ্চে করেই শত শত শিক্ষার্থী নিয়মিত মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকায় যাতায়াত করে। এসব লঞ্চে যাতায়াতে প্রতিমুহূর্তেই ঝুঁকি থাকে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে। ছোট ছোট জরাজীর্ণ এসব লঞ্চে আবারও যেকোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা থেকেই যায়। তাই এই নৌপথের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত কারার দাবি জানাই।

তবে একাধিক লঞ্চ চালক ও মালিকরা বলছেন, অবৈধভাবে নদীতে নোঙর করে রাখা ও বেপরোয়া গতিতে চলাচল করা বিভিন্ন কার্গো জাহাজের জন্য সব থেকে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে চালকসহ যাত্রীদের, এতে যে কোনো মুহূর্তে আবারো বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন।

তাই শিগগিরই এ ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে, নদীপথে অবৈধভাবে নোঙর করে রাখা প্রভাবশালী এসব কার্গো জাহাজ ও তাদের বেপরোয়া চলাচলের বিষয়ে দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।

ফিটনেসবিহীন এসব লঞ্চ ও তাদের মালিকদের পাশাপাশি প্রভাবশালী এসব কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসাইন মো. আল জুনায়েদ বলেন, জরাজীর্ণ এসব ফিটনেসবিহীন লঞ্চের অদক্ষ চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টেও মাধ্যমে আর্থিক জরিমানাসহ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে, এই নৌ পথের যাতায়াত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না আসায় বিশেষ করে আগামী বর্ষা মৌসুমে যাত্রীদের ঝুঁকি বাড়বে আগের থেকে কয়েক গুণ বেশি। তাই কঠোর আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাপদ হবে যাত্রী সেবা। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে বহু প্রাণ এমনটাই মনে করছি আমরা।

মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ ঘাটের ইজারাদার মোহাম্মদ তাপস বলেন, এই নৌ-রুটে ২০ থেকে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করতো। তবে বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌ-রুটে ৮টি লঞ্চ চলাচল করছে। বড় লঞ্চগুলোর মধ্যে খাঁজা, বিপ্লবসহ আরও বেশ কয়েকটি লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ সিমেন্ট কোম্পানি গুলোর যত্রতত্র জাহাজ নোঙর করায় নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট সংকুচিত হয়ে গেছে। যার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

এছাড়াও গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জাহাজ ও লাইটার ভেসেলের সংঘর্ষে লঞ্চ ডুবিতে প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। বর্তমানে জাহাজগুলো এলোমেলো নোঙরের কারণে রাতের আধারে বেড়েছে লঞ্চে ছিনতাই ও ডাকাতি মতো ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে এই পথটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে অনেকাংশেই।

অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, নতুন লঞ্চ নামানোর আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই বর্তমানে। তাই যাত্রীদের কথা চিন্তা করেই আগের লঞ্চগুলো চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।

তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলের নদী বন্দরের উপপরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য জানান, একাধিবার দুর্ঘটনার পর নৌপথ সচল রাখার জন্য পুরনো ১১ লঞ্চকে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে যাত্রী কম থাকায় ৯টি লঞ্চ চলাচল করছে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই।

যাত্রী কমে যাওয়া, লঞ্চ দুর্ঘটনা ও ছিনতাইসহ ডাকাতির মতো ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানার কার্গো জাহাজগুলো নদীতে যত্রতত্র করে রাখে, যার ফলে নদীতে নৌ-পুলিশ প্রতিনিয়ত টহল দেয়। ফলে এখন আর ছিনতাই তেমন ভাবে হচ্ছে না, আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।

তিনি আরও বলেন যত্রতত্র কার্গো জাহাজ নোঙর করে রাখার কারণে-যাত্রীবাহী লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচলে বিঘ্নতা ঘটছে-ছোটখাটো বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটার তথ্যও আমরা পাচ্ছি। তবে এইসব জাহাজের মালিকরা বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরি প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে আমরা তাদের ব্যাপারে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছি না। উপর মহলের চাপে পড়তে হচ্ছে আমাদের। তবে যতটুকু সম্ভব অভিযোগ পেলেই আমারা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। এছাড়াও কার্গো জাহাজ মালিকরা যেনো সিরিয়াল মেনে জাহাজ নোঙর করে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের দ্রুত এমন নির্দেশনা পাঠানো হবে।

তবে যাত্রী কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি তেমন মন্তব্য না করলেও যাত্রী সেবার মানোন্নয়নে। ২০২৩ সালের পরে আর এই লঞ্চগুলো চলাচল করতে দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.