দালাল রুখতে দুই দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে

0 132

ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নাহিদা রহমান সুমনা। ২০২০ সালের জুন মাসে তিনি সে দেশে হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। তিনিই ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী হাইকমিশনার।

বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগামী দিনে কোন কোন বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন।

নাহিদা রহমান সুমনা: ব্রুনাই ও বাংলাদেশ এশিয়ার দুইটি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। গত ২১-২৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রুনাই সফরের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা, উদ্যম ও গতিশীলতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। সে সফরে কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও শিল্প ক্ষেত্র, মৎস্য, পশুসম্পদ, গ্যাস সরবরাহ, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতার ওপর বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া বর্তমানে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, দ্বৈতকর এড়ানো সংক্রান্ত চুক্তি, বিমান পরিষেবা চুক্তি পারস্পরিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সুরক্ষা চুক্তি এবং শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক বিবেচনাধীন রয়েছে।

আমরা উল্লেখিত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। ব্রুনাই বাংলাদেশের জন্য একটা উল্লেখযোগ্য শ্রমবাজার। নির্মাণ খাত ছাড়াও সেবা খাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা সৃষ্টির চেষ্টা করছি। বলা বাহুল্য, বর্তমানে ব্রুনাইয়ের নির্মাণ খাত সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে পুঁজি করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। বর্তমানে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ওপর একটি সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত পর্যায়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। এটি স্বাক্ষরিত হলে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আগমন ও তাদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর আমাদের উদ্যোগে বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং ব্রুনাইয়ের কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় দেশের কৃষি ও পশুসম্পদ সম্পর্কিত উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আমি ব্রুনাইয়ের প্রতিনিধি দলের সব সদস্যকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাই, যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে তা তারা স্বচক্ষে অবলোকন করতে পারেন। ব্রুনাইয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের সবাইকে ব্রুনাই সফরের আমন্ত্রণ জানান। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ থেকে ব্রুনাই অনেক কিছু শিখতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এছাড়া হালাল খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, এনার্জি, তথ্য প্রযুক্তি, জাহাজ নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকচারিং, পর্যটন শিল্প, ব্লু ইকোনোমি প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক উন্নয়নের ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ।

ব্রুনাই বাংলাদেশের একটি অন্যতম শ্রমবাজার। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের অবস্থা এখন কেমন?

নাহিদা রহমান সুমনা: ব্রুনাইয়ে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি শ্রমিক। ব্রুনাইয়ের কন্সট্রাকশন সেক্টর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ থেকে আগত শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। ব্রুনাই প্রায় এক বছরের ওপর করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে রেহাই পেলেও গত আগস্ট ২০২১ হতে আবারো লোকাল ট্রান্সমিশন শুরু হয়। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ না হওয়ার কারণে সংক্রমনের মাত্রা ও পরিমাণ কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। তবে এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে ব্রুনাইয়ের সুলতানের দূরদর্শিতা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ও প্রকোপ ঠেকাতে গিয়েই ব্রুনাই যে প্রতিরোধ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ব্রুনাইয়ে শ্রম বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত আগস্ট ২০২০- এর পর বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় চলে যায়। তবে সংকটাবস্থা কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারো বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ব্রুনাইয়ে এসে কাজ করার সুযোগ পাবেন। উল্লেখ্য, ব্রুনাইয়ে কর্মরত সব প্রবাসী বাংলাদেশি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধক ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে ব্রুনাই মৎস্যখাতে কর্মী নিতে আগ্রহী। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি রয়েছে কি?

নাহিদা রহমান সুমনা: বাংলাদেশ থেকে ব্রুনাই মৎস্যখাতে কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, কারণ মৎস্যখাতে বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই সাফল্য অর্জন করে আসছে। এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

ব্রুনাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সুযোগ কেমন? বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কোন কোন খাতে বাণিজ্যের সুযোগ নিতে পারেন?

নাহিদা রহমান সুমনা: ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.১১ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য ব্রুনাইয়ে রপ্তানি করে; এর বিপরীতে ব্রুনাই থেকে বাংলাদেশ ০.৫১ মিলিয়ন ইউএস ডলার সমমূল্যের পণ্য আমদানি করে। যদিও সম্প্রতি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৫ লাখ জনগোষ্ঠীর ছোট এই দেশটির অর্থনীতির আকার প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। ব্রুনাইয়ের দেশীয় পণ্যের (জিডিপি) পরিমাণ ১২.০২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, মাথাপিছু আয় ৩১,৫০১ ইউএস ডলার, অন্যদিকে বাংলাদেশের জিডিপি ৪০৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ ইউএস ডলার। এটা সহজেই অনুমেয় যে, জনসংখ্যার অপ্রতুলতা ও অর্থনীতির আকার ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য কারণ, বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তবে সম্প্রতি ব্রুনাইয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রাণ গ্রুপ ও প্লানেট এগ্রো লিমিটেড অন্যতম।

ব্রুনাইয়ে জনশক্তি পাঠাতে দালাল চক্রের অনেক বেশি অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

নাহিদা রহমান সুমনা: ব্রুনাইয়ে জনশক্তি পাঠাতে দালাল চক্রের অনেক বেশি অর্থ আদায়ের অভিযোগ সম্পর্কে আমি অবগত। তবে এই দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমাতে হলে দুই দেশকেই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। তবে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রুনাইয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইমিগ্রেশন বিভাগসহ অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি যাতে কেউ অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে এবং যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া, মজুরি ও অন্যান্য অধিকার প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা না হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে দুই দেশের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি কেমন?

নাহিদা রহমান সুমনা: ২১-২৩ এপ্রিল ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রুনাই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ব্রুনাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সে সফরে কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও শিল্প ক্ষেত্র, মৎস্য, পশুসম্পদ, গ্যাস সরবরাহ, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতার ওপর বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব বিষয়ে অগ্রগতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও আমরা আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। আশা রাখি আগামী দিনগুলিতে সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হবে। শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং এয়ার সার্ভিস চুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে।

আগামী দিনে ব্রুনাইয়ের সুলতানের বাংলাদেশ সফরের কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি?

নাহিদা রহমান সুমনা: করোনা মহামারিতে বিশ্ব আজ যে অচলাবস্থার সন্মূখীন হয়েছে, সে পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী করা সম্ভব হচ্ছে না। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ওমিক্রনসহ করোনা ভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের নিত্যনতুন আবির্ভাব ও সংক্রমন ঠেকাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ব্রুনাইও চিন্তিত ও নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করছে। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ব্রুনাইয়ের মহামান্য সুলতানের বাংলাদেশে সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।

ব্রুনাইয়ের প্রবাসীরা হাইকমিশন থেকে যে সেবা পাচ্ছেন, আপনি কি এই সেবার মানে সন্তুষ্ট?

নাহিদা রহমান সুমনা: ব্রুনাইয়ে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন, এর মধ্যে যেমন আছেন নির্মাণ শ্রমিক, তেমনি আছেন ডাক্তার, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশার মানুষ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বদৌলতে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহের কারণে সেই স্বাধীন ও সুন্দর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার যে সৌভাগ্য আমি অর্জন করেছি তার জন্য তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই বাংলাদেশের মানুষের দেখভাল করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা ব্রুনাইয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করছি। তাদের স্বার্থ আমরা অন্য সব কিছুর চেয়ে এগিয়ে রাখি। বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাই। প্রায় প্রতিদিন আমরা হাইকমিশন প্রাঙ্গনে শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনি এবং সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি। এছাড়া পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন সনদ, নো ভিসা রিকোয়ার্ড (এনভিআর) ইত্যাদি কন্স্যুলার সেবা যাতে কোনরকম বিঘ্ন ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা পেতে পারেন তা নিশ্চিত করতে আমি হাইকমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে আসছি।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.