আমদানিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব, কমে গেছে ২৩%

0 126


করোনাভাইরাসের প্রভাবে এক মাসের ব্যবধানে চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি টাকার অঙ্কে প্রায় ২৩ শতাংশ কমেছে। তবে চীনের পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হওয়ায় সেখানকার ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

যবসায়ীরা এখনো কাঁচামাল আমদানি নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেননি। চীনের হুবেই প্রদেশ ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে প্রস্তুত থাকা কাঁচামাল ও পণ্য সরবরাহ সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। এসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। কারখানায় উৎপাদন শুরু হওয়া পণ্য আসতে আরও সময় লাগবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে পণ্য আমদানি কমার প্রভাব থাকবে মার্চের শেষ পর্যন্ত। পণ্য রপ্তানি যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য এরই মধ্যে চীন থেকে উড়োজাহাজে করেও কাঁচামাল নিয়ে আসতে শুরু করেছেন রপ্তানিকারকেরা।

এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের কাছ থেকে কম সাড়া পাচ্ছেন রপ্তানিকারকেরা। কারণ, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এসব দেশে পর্যটন খাতে মন্দা শুরু হয়েছে।

শেয়ারবাজারে দরপতন চলছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমতে থাকায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাবে। এ সময় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক কিংবা জুতার মতো পণ্যের চাহিদা কমবে।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি কমে যাওয়ার পর এক সপ্তাহ ধরে এখন চীনে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এমন সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিক্রি কমেছে বলে জানিয়েছেন। রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে অন্তত দুই মাস পর। চীনের ধাক্কা সামলে ওঠার আগে এমন আভাস বছরজুড়ে রপ্তানি খাতে বড় নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে।

আমদানি কমেছে ২৩ শতাংশ

ফেব্রুয়ারিতে নতুন ঋণপত্রের পণ্য জাহাজীকরণ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমদানিতে প্রভাব পড়েছে। মূলত জানুয়ারি মাসে চীনের পাঠানো পণ্য এসেছে ফেব্রুয়ারি মাসে।

ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ায় এবার শঙ্কা রপ্তানিতে
আক্রান্ত দেশগুলোর ৪৯টিতে দেশের ৮৭ শতাংশ পণ্য রপ্তানি হয়

রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, চীন থেকে জানুয়ারি মাসে বাণিজ্যিক পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার। তবে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি কমে হয়েছে ৮ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ এক মাসে পণ্য আমদানি কম হয়েছে ২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকার (২৩ শতাংশ)। পণ্যের হিসাবে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার টন। ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয় ৪ লাখ ৬৫ হাজার টন।

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানি কমেছে বেশি। যেমন শিল্প লবণ আমদানি কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে শিল্প লবণ আমদানি হয় ৫৩ হাজার টন। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টনে। পোশাক খাতের সেলাই মেশিন জানুয়ারিতে আমদানি হয় ১৮৫ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে হয় ৪৭ কোটি টাকার। রপ্তানিমুখী জুতা শিল্পের কাঁচামাল জানুয়ারিতে আমদানি হয় ৯০ কোটি টাকার, ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয় ৭০ কোটি টাকার। কমেছে ভোগ্যপণ্য আমদানিও। রসুন আমদানির পুরোটাই আসত চীন থেকে। এই পণ্যটি জানুয়ারিতে আসে ১১ হাজার ৬৭৭ টন। ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ৬ হাজার ৯৪৯ টন।

চীন থেকে জাহাজে পণ্য পরিবহনকারী কোরিয়ার হুন্দাই মার্চেন্ট মেরিনের স্থানীয় প্রতিনিধি ওশেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান ইকবাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চীনের সাংহাই থেকে আসা ‘কেপ ওয়িয়েন্ট’ জাহাজটি প্রতিবার গড়ে ১ হাজার ৬০০ কনটেইনার পণ্য নিয়ে আসত। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি বন্দরে পৌঁছেছে মাত্র ৮৮৫ একক কনটেইনার পণ্য নিয়ে। ৬ মার্চ ‘কুইন এস্টার’ নামে যে জাহাজটি বন্দরে পৌঁছাবে, তাতেও পণ্যের পরিমাণ কম। চীনের বন্দরে জাহাজীকরণ পুরোদমে শুরু হতে আরও সময় লাগবে। স্বাভাবিক হলেও মার্চের শেষে পণ্য আমদানি বাড়তে পারে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে আমদানি কমলেও নতুন করে আমদানি শুরু হওয়ার ইঙ্গিত কিছুটা ইতিবাচক। তবে ভাইরাসের বিস্তৃতি না হলেও সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও দুই মাস লেগে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে বিকল্প বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে হলেও আমদানি করে রপ্তানিমুখী খাত সচল রাখা উচিত। ব্যয় বাড়লে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে বোঝাপড়া শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রপ্তানি কমার আভাস

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চীনের বাইরে ৫৯টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ভাইরাস ছড়ানো ৫৯ দেশের মধ্যে ৪৯টিতেই পণ্য রপ্তানি হয় বাংলাদেশের। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৮৭ শতাংশ আসে এসব দেশ থেকে। এর পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

আবার রপ্তানির শীর্ষ ১০টি গন্তব্যের ৯টিতেই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এই ৯টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, কানাডা, নেদারল্যান্ডস। এসব দেশ থেকে আসে মোট রপ্তানি আয়ের ৬৮ শতাংশ বা ২৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।

ইউরোপের দেশগুলোতে প্যাসিফিক জিনসের পণ্য রপ্তানি হয়। প্যাসিফিক জিনসের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, এখনো রপ্তানি আদেশ কমেনি। তবে যেভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে, তাতে রপ্তানি খাতে প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

রপ্তানিমুখী জুতা কারখানা আরজেএম ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের ক্রেতারা এখনই রপ্তানি আদেশ কমানোর আভাস দিয়ে রেখেছেন। এখন যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, সেগুলোর বিক্রি যদি কমে যায় তাহলে নতুন করে রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দেবেন বিদেশি ক্রেতারা। এ বছর জুতা রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা আছে।

এমনিতেই রপ্তানি আয় কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাত মাস শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৯২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কম। অর্থনীতির সব সূচকের মধ্যে শুধু ভালো আছে প্রবাসী আয়।

সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এখন অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়সহ নতুন করে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। আবার রপ্তানি আয়ে যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, তা করোনাভাইরাসের কারণে আরও নেতিবাচক হতে পারে। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে। তবে ইতিবাচক দিক, এখানে এখনো করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। আর শঙ্কার দিক হলো, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে যেভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার, সেটি দেখা যাচ্ছে না। কোনো কারণে এখানে সংক্রমণ হলে পরিস্থিতি অনেক বেশি ভয়াবহ হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.