পরামর্শক কমিটির কাছে যে পরামর্শগুলো পেয়েছি সে-গুলো যৌক্তিক কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন- প্রশাসক সুজন

0 226

চট্টগ্রাম সংবাদঃ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, নাগরিক দুর্ভোগমুক্ত এবং সর্বসাধারণের সুযোগ-সুবিধা সমন্বিত একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলাই আমার স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার তা নেই। আমি সীমিত সময়ের জন্য প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি বিশাল অংকের দেনার বোঝা নিয়ে। আমি নগরীর বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং যেগুলোর জরুরী ভিত্তিতে নিরসন প্রয়োজন সে-জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি। পরামর্শক কমিটির কাছে যে পরামর্শগুলো পেয়েছি সে-গুলো যৌক্তিক কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে আগামীতে চসিকের নির্বাচিত পরিষদ চট্টগ্রামকে যেন বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করতে পারেন সে-জন্য কী ধরণের কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার তার একটি ধারণা আমি রেখে যেতে চাই। তিনি আজ সকালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরামর্শক কমিটির সাথে ভার্চুয়াল সভায় একথা গুলো বলেন।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সেবা মূলক কার্যক্রম চলমান রাখতে সরকারের কাছে বরাদ্দ চেয়েছি। ইতোমধ্যে কিছু থোক বরাদ্দ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারী সেবাসংস্থামূলক বিশেষ করে চট্টগ্রম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তারা তাদের ভারী যানবাহন ও কন্টেইনারগুলো চসিকের রাস্তাগুলো ব্যবহার করে। এই রাস্তাগুলোর উপর ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েকগুণ বেশি মালামাল পরিবহনের গাড়িগুলোর কারণেই এগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্দরের মোট আয় থেকে শতকরা ১ অংশ সার্ভিস চার্জ চেয়েছি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ল্যান্ডিং অবস্থান এই নগরীতে। এ কারণে তাদের কাছ থেকেও সার্ভিস চার্জ চসিক পেতে পারে। ইপিজেড হোল্ডিং ট্যাক্স না দিলেও সার্ভিস চার্জ অবশ্যই দেয়া দরকার। ভারী শিল্প, বিশেষ করে ইস্পাত কারখানাগুলোর ভারী যানবাহন এই নগরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। তাই রাস্তাঘাট নষ্ট হয়। তাদের ভারী যানবাহনগুলো অবৈধভাবে সড়কের উপর পার্কিং করেন। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী বন্দরের কোন পরিবহন টার্মিনাল নগরীর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে পারে না। কিন্তু বন্দরের আশে-পাশে অন্তত ২০টি স্পটে তাঁদের কন্টেইনার স্ট্যান্ড রয়েছে। ফলে সী-বীচের পর্যটন স্পটে যাওয়াটা ভ্রমনপিপাসুদের জন্য দুরুহ হয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলেন, সরকারী সেবাসংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গুলোতে নতুন ধার্যকৃত করের তালিকা দিয়েছি। আশা করি তাঁরা চসিকের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি আমলে আনবেন। আমাদেরকে শিক্ষাখাতে বড় অংকের ভুর্তুকি দিতে হয় এবং একই ভাবে স্বাস্থ্যখাতকেও দিতে হচ্ছে। আমি আগেও বলেছি, চট্টগ্রাম নগরীতে সরকারী সেবা সংস্থার বড় বড় মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এই কাজের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে এবং নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সমন্বয় দরকার। ওয়াসাকে বলেছি, সড়ক খোঁড়াখুড়ির আগে সিটি কর্পোরেশনকে জানাতে হবে কোথায় হচ্ছে। কিন্তু তারা আমাদের অনুরোধ আমলে আনেন না। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি চট্টগ্রামে খেলার মাঠের অভাবের কথা জানিয়ে বলেন, আমাদের সন্তানরা খেলাধুলা করতে পারে এমন কয়েকটা মাঠ দরকার। বাকলিয়ায় যে স্টেডিয়াম আছে সেখানে একটি ক্রিকেট একাডেমী করে দিলে ভাল হয়। আউটার স্টেডিয়াম খেলাধুলার উপযোগী করা হয়েছে। তবে অপরিকল্পিত সুইমিং স্টেডিয়ামের কারণে এই মাঠের একটি বড় অংশ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠে একটি শিশু পার্ক করা হয়েছে। এই পার্কের অধীনে বিস্তর জায়গা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এখানে যে বিনোদন কেন্দ্রটি আছে এটি আকর্ষণীয় নয়। এটাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে খেলার মাঠসহ একটি অত্যাধুনিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স চাই। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, নগরীতে কোথাও মার্কেট তৈরী করতে হলে আগে চসিকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তা তোয়াক্কা না করে নেভী রেডিসনের সামনে সারি সারি দোকান তৈরি করে মার্কেট বানানো হয়েছে। ঠান্ডাছড়িতে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী একটি রিসোর্ট পার্ক গড়ে ছিলেন। এখানে সিটি কর্পোরেশনে বিস্তর জায়গা রয়েছে। একটি শিল্পগ্রæপ এই জায়গাটাকে জিম্মি করে রেখে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নমূলক কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। কেউ কেউ মনে করে তারা রাষ্ট্রের চাইতেও বড়।

পরামর্শক কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব, ব্র্যাকের সিনিয়র এ্যাডভাইজার মো. আবদুল করিম বলেন, সরকারের গুরুত্বপূণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ উধ্বর্তন পদে বর্তমানে চট্টগ্রামের সন্তানরা দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক সাবেক কর্মকর্তাও দায়িত্বপালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বর্তমান মূখ্যসচিব চট্টগ্রামের সন্তান। সবাইকে একসাথে নিয়ে ঢাকায় একটি সভা করা দরকার। এখান থেকে চট্টগ্রামের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত আসতে পারে।  চসিক সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সমন্বয়ের জন্য দরকার একজন মূখ্য কান্ডারী। এখানে নগর সরকারের কথা উঠেছে। ১৯৮২ সালে সিটি কর্পোরেশন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন না হলে নগর সরকার বাস্তবায়ন হবে না। সিটি কর্পোশেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভুর্তুকি দেয়া হচ্ছে। তবে ভর্তুকি দেয়ার জন্য নগরবাসী ট্যাক্স দেয় না। এজন্য চট্টগ্রামের শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি বৈঠক করা দরকার এবং এই বৈঠক থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত বের করে নিতে হবে।

দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক ডা. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, চসিকের কাছে আমাদের অনেক আশা। তাদের মূল সেবাগুলো নগরবাসী পাচ্ছে কিনা এবং বাড়তি কি পাওয়া উচিত তা আমাদের ভাবতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। কিন্তু জনবল বাড়েনি। তহবিলও বাড়েনি। তাই লোকবলের অভাব ও আর্থিক সামর্থ্যরে যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। প্রত্যেক দেশে একটি লবিং গ্রæপ থাকে। সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেরও একটি লবিং গ্রæপ থাকা দরকার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য, বিএন,এনডিসি কমডোর জোবায়ের আহমদ বলেন, কর্ণফুলী বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে, চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। তাই আগে কর্ণফুলীকে বাঁচানোর জন্য নিয়মিত ও সঠিকভাবে ড্রেজিং সবচেয়ে বেশি দরকার। এতে স্বাভাবিকভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর টান্সশীপমেন্ট ও একটি ট্রান্সজিট কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিবেশ সৃষ্টির ফলে চট্টগ্রামের সড়কগুলো দিয়ে ভারতের ৭ টি রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটানে ভারী পরিবহন চলাচল করবে। তাই আমি দাবী করব ট্রান্সশীপমেন্ট ও ট্রানজিট থেকে দেশের যে আয় হবে তা থেকে একটি অংশ চসিকে দিতে হবে।

এশিয়ান গ্রুপেরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র ১ম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ এ সালাম বলেন, চট্টগ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এটাকে জাতীয় শ্লোগানে পরিণত করতে হবে। চট্টগ্রামে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কিন্তু সমন্বয় নেই। তাই সমস্ত সেবামূলক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে একই ছাতার নিতে আসতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক আইজিপি মো. নুরুল আলম বলেন, চসিককে বাঁচাতে হলে ঢাকা থেকেই দাবী তুলতে হবে। আমরা ঢাকায় চট্টগ্রাম সমিতির মাধ্যমে চট্টগ্রামের স্বার্থে অনেক দাবী তুলেছিলাম। এখন সেগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। এজন্য লবিং গ্রুপ তৈরির যে প্রস্তাবটি এসেছে তাকে আমি জোড়ালো ভাবে সমর্থন করি।

শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বলেন, আমি চাইছি চসিকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বন্ধ হয়ে না যায়। দেশে আর কোন সিটি কর্পোরেশনে এত ব্যাপক শিক্ষাখাত নেই। আমি আশা করব যুগের চাহিদা অনুযায়ী চসিক ভিত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান চালু হোক।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক আকরাম খান বলেন, বিশ বছর আগে ক্রিকেট সহ যেকোন জাতীয় দলে চট্টগ্রাম থেকে ৭/৮জন প্রতিনিধিত্ব করতো। বর্তমানে জাতীয় ক্রিকেট দলে তামিম ছাড়া আর কেউ নেই। এর কারণ চট্টগ্রামে ক্রীড়া উপযোগী মাঠগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের বাড়ির সামনে, আউটার স্টেডিয়ামে ও সার্কিট হাউসের সামনে মাঠে খেলাধুলা করে জাতীয় দলে ঠাই করে নিতে পেরেছিলাম। আরেকটি জিনিস মনে রাখতে হবে খেলাধুলার স্থান সংর্কীণ হয়ে গেলে নতুন প্রজন্ম বিপদগামী হবে, মাদকাসক্ত হবে। আমি প্রশাসক বাকলিয়া স্টেডিয়ামে ক্রিকেট একাডেমী করার যে আগ্রহের কথা বলেছেন আমি তার সাথে সহমত পোষন করছি।

চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে অনেক বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পের অর্থ অপচয় হচ্ছে।
চসিকের সচিব আবু সাহেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও অনারারি কনসাল, রাশিয়া স্থপতি আশিক ইমরান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, আইইবি চট্টগ্রামের সভাপতি প্রবীর কুমার সেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ ও প্রশাসকের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম।

Leave A Reply

Your email address will not be published.