চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা মানবিক পুলিশের মডেল থানা

0 121


গভীর রাত। যন্ত্রণায় কাতর মুমূর্ষু গর্ভবতী। যানবাহন শূন্য সড়ক। করোনা আতঙ্কে সাহায্য করার জন্যও কেউ নেই আশপাশে। হঠাৎ একটি নাম্বারে ফোন। সঙ্গে সঙ্গেই হাজির কয়েকজন মানুষ এবং গাড়ি। অজানা আতঙ্কের রাত ভেদ করে ওই গর্ভবতীর ভোর হয় যমজ সন্তানের মুখ দেখে! আর দেবদূত হয়ে হাজির হওয়া ওই মানুষ ছিল পুলিশ! গাড়িটা ছিল আসামি বহনের ভ্যান! এটিই একমাত্র ঘটনা নয় করোনায় কমপক্ষে এমন ২০ ঘটনার সাক্ষী এই পুলিশ দল এবং এই গাড়ি।
বাবা করোনা আক্রান্ত। শেষ মুহূর্তের চেষ্টা চলছে। প্লাজমা প্রয়োজন। হন্যে হয়ে খুঁজেও ব্যবস্থা করতে পারেনি সন্তান। শেষে পুলিশই ব্যবস্থা করে দেয় প্লাজমার। সেই বাবা বেঁচে আছে। এখন সুস্থ আছেন। এরপর এভাবে চট্টগ্রামে আরও ৩০ জন পেয়েছেন প্লাজমা থেরাপি।
করোনার শুরুতেই ডাক্তারের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। চেম্বার বন্ধ, ডাক্তার নেই। তখনই চট্টগ্রামবাসীর পাশে দাঁড়ায় ‘হ্যালো ডাক্তার’। ফোনে চিকিৎসা পেয়ে কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচে চট্টগ্রাম। মনে হতে পারে এটি ডাক্তারদের কোনও সেবা। না, এটিও পুলিশেরই একটি সেবা!
করোনাকালে বেশকিছু ওষুধ ঘুরে ফিরছে মানুষের মুখে। ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নেয় এই হুজুগের। করোনায় ব্যবহৃত অধিকাংশ ওষুধই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুই থেকে তিনগুণ দাম বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। ওষুধের কৃত্রিম সঙ্কটে পড়ে চট্টগ্রাম। তখনই চট্টগ্রামে স্বস্তি নিয়ে আসে ‘আমার ফার্মেসি’ নামে একটি উদ্যোগ। ফোন করলে ঘরেই পোঁছে গেছে ওষুধ! তাও ১৫ শতাংশ ছাড়ে! এটা কোম্পানির প্রচারের জন্য ব্যবসায়িক কোন উদ্যোগ নয়। এটিও পুলিশের মানবিক একটি উদ্যোগ!
মনে হতে পারে, উপরের সবগুলো করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশের করা মানবিক কাজগুলোর সারাংশ। কিন্তু না, উপরের সবগুলো কাজই চট্টগ্রামের শুধুমাত্র একটি থানার কাজেরই অংশ বিশেষ! করোনায় পুলিশকে অন্যভাবে চিনেছে বাংলাদেশ। সেই ব্যতিক্রমী পুলিশিংয়ে নিজেদের আরও স্বতন্ত্রভাবেই উপস্থাপন করেছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা। গোপনে মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর দাফন পর্যন্ত করে আলোচিত হয়েছে এই থানা। চট্টগ্রামের থানাগুলোর মধ্যে ওসিসহ সর্বোচ্চ ৪১ জন আক্রান্ত হওয়ার বিনিময়ে চট্টগ্রামবাসীর মন জয় করেছে ‘টিম কোতোয়ালী’ নামে খ্যাতি পাওয়া মডেল এই থানা।
এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘করোনা আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের আস্থা কুড়ানোর। আমরা সে সুযোগ লুফে নিয়েছি। মানুষের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে যখন যে উদ্যোগ প্রয়োজন সেটা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি। আমাদের উদ্যোগ মানুষের উপকারে এসেছে, মানুষ আমাদের ভালোবাসছে, এটাই আমাদের অর্জন। এটা যেন অব্যাহত থাকে সেই চেষ্টাই থাকবে আমাদের।’
পুলিশভ্যানে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস:
করোনার শুরুতেই লকডাউন শুরু হলে যানবাহন শূন্য নগরে বিপাকে পড়েন সাধারণ রোগীরা। এসময় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় কোতোয়ালী থানা। থানায় ফোন করলে থানার গাড়িতেই হাসপাতালে পৌঁছে দেয় পুলিশ। করোনাকালে কমপক্ষে ২০ জন রোগী এই সেবা পায়।
হ্যালো ডাক্তার:
করোনার শুরুতেই চট্টগ্রামে ডাক্তারদের চেম্বারে তালা ঝুলে। কোন ডাক্তারই পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনই ১০ জন ডাক্তারের সমন্বয়ে চট্টগ্রামে শুরু হয় টেলি মেডিসিন সেবা ‘হ্যালো ডাক্তার’। ০১৮৭০ ৭০০ ৭০০ নাম্বারে ফোন করেই চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন চট্টগ্রামবাসী। আর এই পুরো উদ্যোগই গ্রহণ করে কোতোয়ালী থানা।
প্লাজমা ব্যাংক:
চট্টগ্রামে প্রথম প্লাজমা দেয়া হয় ডা. সামিরুল ইসলাম বাবুকে। প্রথম প্লাজমা দাতা মিয়া মো. তারেকের মাধ্যমে এই নজিরও কোতোয়ালী থানার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোগী মারা গেলেও এ পর্যন্ত ৩০ জন রোগীকে প্লাজমার ব্যবস্থা করেছে এই থানা। সমসংখ্যক প্লাজমা দাতা প্রস্তুত আছেন দেয়ার জন্য।
আমার ফার্মেসি:
করোনায় চট্টগ্রামবাসীকে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয় ওষুধ নিয়ে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওষুধের দাম দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। বারবার অভিযান চালিয়েও কোনও সুফল না পাওয়ায় শেষে চালু করা হয় ‘আমার ফার্মেসি’ নামের ওষুধের হোম সার্ভিস। ০১৮৭০ ৭০০ ৭০০ নাম্বারে ফোন করলে বাসায়ই পৌঁছে যাবে ওষুধ। ১৫ শতাংশ ভর্তুকি এবং ২০ জন স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী প্রশংসনীয় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে টিম কোতোয়ালী।
করোনা প্রতিরোধ বান্ধব বাজার:
করোনার হটস্পট ধরা হয় বাজারকে। উন্মুক্ত স্থানে বাজার স্থানান্তর করে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বাজার জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে বৃত্ত, ক্রেতা বিক্রেতার মাস্ক, গ্লাভস পড়া বাধ্যতামূলক করা, অসুস্থদের আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি এবং হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ করোনা প্রতিরোধী বিভিন্ন ব্যবস্থাসহ বাংলাদেশের প্রথম করোনা প্রতিরোধ বান্ধব বাজার স্থাপন করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা। স্বরাষ্ট্র সচিব এই বাজার উদ্বোধন করেন।
ডোর টু ডোর শপ:
করোনার শুরুতেই লকডাউন শুরু হলে মানুষের চলাচল সীমিত করে পুলিশ। এসময় মানুষের ঘরে থাকাকে উদ্বুদ্ধ করতে সিএমপির অংশ হিসেবে ‘ডোর টু ডোর’ শপ চালু করে কোতোয়ালী থানা। ফোন করলে ঘরেই বাজার পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ। দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়েছে এই উদ্যোগ।
ড্রোন উড়িয়ে লকডাউন কার্যকর:
মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত এবং বাইরে আড্ডাবাজি বন্ধে দেশে প্রথমবারের মতো ড্রোন উড়িয়ে লকডাউন কার্যকর করে কোতোয়ালী থানা। সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে অযথা ঘুরাঘুরি করে ৬ জন গ্রেপ্তারও হয়েছেন এই থানায়।
হ্যালো অ্যাম্বুলেন্স:
দেশে প্রথমবারের মতো থানার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। আর এই অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহৃত হবে থানা সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষদের জন্য। ফোন করলেই পুলিশই রোগীকে বিনামূল্যে হাসপাতালে পৌঁছে দিবে। অ্যাম্বুল্যান্স প্রস্তুত। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে এই সেবা।
গান গেয়ে সচেতনতা:
কোতোয়ালী থানার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ছিল গান গেয়ে সচেতনতা সৃষ্টির আয়োজন। করোনার করণীয় এবং বর্জনীয় নিয়ে রচিত এই গান ভাইরালও হয় নেট দুনিয়ায়। ৩৫ লক্ষাধিক মানুষ এ গান দেখে ইন্টারনেটে!
ত্রাণ সহযোগিতা:
কোতোয়ালী থানা ত্রাণ সহযোগিতায় নামে করোনার প্রথম দিন থেকেই। যখন মাস্ক ও স্যানিটাইজার নিয়ে সিন্ডিকেট শুরু হয় তখনই ১০ হাজার মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিলি করা হয় এলাকাবাসীর মধ্যে। রাতে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয় ত্রাণ সহযোগিতা। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে কোতোয়ালী থানা।
করোনা রোগীদের জন্য ভালবাসার বক্স:
করোনা রোগীদের উৎসাহ দিতে করোনা রোগীদের নিয়মিত দেখতে যান এই থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন। এসময় তাদের জন্য উপহার হিসেবে ‘ভালবাসার বক্স’ নিয়ে যান তিনি। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে চট্টগ্রামবাসীর।
এছাড়াও পুরো সড়কে জীবাণুনাশক ছিটানো, দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, বিনোদন কেন্দ্রে জমায়েত ঠেকানো, মাইকিং ও মসজিদে মসজিদে সচেতনতা সৃষ্টি, লকডাউন কার্যকর, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতকরণ, করোনায় মৃতদের দাফনে সহযোগিতা, চিকিৎসকদের ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, করোনা রোগী এবং ফ্রন্ট লাইনারদের সঙ্গে বাড়িওয়ালাদের বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মতো সময়োপযোগী জন বান্ধব কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করেছে এই থানা।
জনমুখী এসব কাজ করতে গিয়ে এই থানার ৪১ জন পুলিশ অফিসার আক্রান্ত হয়েছেন যা চট্টগ্রামের থানাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবুও দমে যায়নি টিম কোতোয়ালী। নিত্যনতুন চমক দিয়ে নতুন নতুন সেবা নিয়ে হাজির হচ্ছে মানুষের মন জয় করা এই থানা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, করোনা সময়ে পুলিশ সদস্যরা মানবিকতার পক্ষে কাজ করেছে। কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এরপরও কাজ করে গেছেন। ভবিষ্যতেও পুলিশ সদস্যরা মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.