আরো ৫০ লাখ দরিদ্রকে রেশন কার্ড দেয়া হবে : প্রধানমন্ত্রী

0 271


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামারি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য আরো ৫০ লাখ দরিদ্র লোককে ১০ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহের জন্য রেশন কার্ড সুবিধার আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা বিভাগের বিভাগের নয়টি জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিভিল সার্জনসহ চিকিৎসক, সশস্ত্র বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সর্বশেষ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়কালে তিনি এই ঘোষণা দেন। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত ছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে ৫০ লাখ চরম দরিদ্র ও দুস্থ মানুষ সরকারের রেশন কার্ড সুবিধার আওতায় প্রতি কেজি ১০ টাকায় চাল পাচ্ছেন। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা আরও ৫০ লাখ লোককে এই সুবিধার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ যারা হাত পেতে খেতে পারবে না তাদের জন্যই তাঁর সরকার ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যে ৫০ লাখ রেশন কার্ড আরো অতিরিক্ত দেব সেখানে যারা সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন এবং যাদের ইতোমধ্যেই রেশন কার্ড রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে যাদের সত্যিকার প্রয়োজন তাঁদের নামটা যেন তালিকায় থাকে।

ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মীদের প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডে কমিটি করতে বলেছেন যাতে যারা সত্যিকার দুস্থ এবং যাঁদের ঘরে খাবার নেই তাঁদের খুঁজে বেরা করা যায়, বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাছে সাহায্য যেন পৌঁছায় সেজন্য ইতোমধ্যেই আমরা নির্দেশ দিয়েছি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে যে সহায়তা দেব সেটা যেন সঠিক লোকের কাছেই পৌঁছায়। সেখানে যেন কেউ অনিয়ম করতে না পারে। সেদিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।’

তিনি বলেন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশ্ব মন্দা এমনকি দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশংকা ব্যক্ত করায় দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য তার সরকার ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি করেছে। সরকার প্রধান বলেন, এই প্যাকেজ শুধু আজকের জন্যই নয়, উপরন্তু আগামী তিন বছর কিভাবে এই মন্দার থেকে রক্ষা পাওয়া যায় সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই করা হয়েছে। তিনি এসময় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে পুনরায় গুরুত্বারোপ করে কোথাও এক টুকরো জমিও যেন পতিত না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঘরের পাশের এক চিলতে জায়গা থাকলে সেটাকেও কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি খানিক বাদে বাদে গরম পানি খাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ফ্লাস্কে গরম পানি রেখে খানিক বাদে বাদে পান করতে থাকলে গলাটা পরিষ্কার থাকবে। তাহলে এই ভাইরাসটা আর ক্ষতি করতে পারবে না। সেই সাথে মওসুমী যে ফলগুলো রয়েছে সেগুলো খেয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।’ যারা বাইরে থেকে আসছে তাদের দ্বারাই এই ভাইরাসটা নতুন নতুন জায়গায় সংক্রমিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী লকডাউন কঠোরভাবে অনুসরণের এবং কোন জেলায় নতুন করে কেউ প্রবেশ করতে গেলে তাকে বাধা প্রদান করে সেখানেই লকডাউনের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, যেখানে ন্যূনতম এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে সেখানে যাওয়া যাবেনা। কারণ, অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি অবস্থা ভাল ছিল কিন্তু অন্য জায়গার থেকে লোকজন আসার ফলে সংক্রমণ হয়েছে।

সৌদি আরবে পর্যন্ত মসজিদে জামাত বন্ধ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমনকি তারাবির নামাজও সেখানে ঘরে বসে সবাই পড়বে। মন্দির, মসজিদ, গীর্জা এমনকি ভ্যাটিক্যান সিটিতে পর্যন্ত এ ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা আসন্ন মাহে রমজানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত আপনি সব জায়গায় বসে করতে পারবেন। আপনারা ইসলামী ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা মেনে ঘরে বসেই তারাবির নামাজ পড়বেন। আর আল্রাহকে ডাকতে হবে। সেটা আপনি আপনার মত করে যত ডাকতে পারবেন, মহান রাব্বুল আলামিন সেটাই কবুল করবেন।’ তিনি বলেন, ‘মসজিদে গিয়ে নিজেকে সংক্রমিত করবেন না বা অন্যের সংক্রমণের কারণ হবেন না। সামনে রোজা। সে সময় পণ্য পরিবহন এবং খাদ্য সামগ্রীর যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্য আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছি।’ সরকার প্রধান বলেন, ‘জীবনকে চলমান রাখার জন্য যেটুকু না করলেই নয় সেটুকু কাজ করবেন,অযথা কোথাও ঘোরাঘুরি করবেন না।’

প্রধানমন্ত্রী গত ১২ এপ্রিল খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ টি জেলার জনপ্রতিনিধি এবং কর্মকর্তাদের সাথে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করেন। এর আগে তিনি একই ইস্যুতে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৫টি জেলার জনপ্রতিনিধি এবং কর্মকর্তাদের সাথে এবং সারাদেশে একযোগেও ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৮৬৮ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে রোগ শনাক্ত হয়েছে ১২শ’ ৩১ জনের। আর মারা গেছে ৫০ জন। ৫০ জনের উপরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। অনেকেই কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

সমগ্র বিশ্বের অবস্থা আরো ভয়াবহ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গতকাল ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে মারা গেছে এক লাখ ১৭ হাজার ২১ জন। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে ভাগে ব্যবস্থা গ্রহণ করাতেই এখনও এটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। তবে, কেউ মারা যাক সেটা আমরা চাই না, সবাই সুস্থ থাকুক সেটাই আমরা চাই। আর সেজন্য এই ভাইরাস যেন আর না ছড়াতে পারে সেজন্য যা যা করণীয় আপনাদেরকে করতে হবে।’ মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের প্রশাসন এবং পুলিশসহ আইন শৃক্সখলা রক্ষাকারি বাহিনী থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ড, কোস্ট গার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ডাক্তার নার্সসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি কারণ, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাঁরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

দেশের ১৭টি জায়গায় সরকার করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী সকলের জন্য পিপিইসহ সবরকমের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোগীদের জন্য চিকিৎসা এবং বেডের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোথাও করোনা আক্রান্তের খবর পেলেই তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এ পর্যন্ত ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৬১৬ পিস পিপিই সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ ৫৮ হাজার ২৯৪টি বিতরণ করা হয়েছে। মজুদ আছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩২২ পিস এবং প্রতিনিয়ত তাঁর সরকার এটি সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এ সময় তিনি অবসরে চলে যাওয়া চিকিৎসক এবং নার্সদেরকে কাজে লাগানোর বিষয়েও সংশ্লিষ্ট মহলকে পরামর্শ দেন। আতংকিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণের উদ্দেশে তাঁর উদাত্ত আহ্বান ও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে অনেক সময় অমানুষেও পরিণত হয়ে যায়। একটু সর্দি-কাশি-জ্বর হলো বলে আপনজনকে তুলে নিয়ে জঙ্গলে (নির্জন স্থানে) ফেলে আসার মত অমানবিক ঘটনারও সংবাদ পাওয়া গেছে। যে অমানবিকতার কোনো দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘কারো সন্দেহ হলে পরীক্ষা করান, চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং নিজেরাও সুরক্ষিত থাকেন এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখেন। হায়াৎ-মউত আল্লাহর হাতে। যে কেউ যেকোনো সময় মরতে পারেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না।’

শেখ হাসিনা তালিকা করা বা ত্রাণ বিতরণের সময় দলমত বিচার না করার জন্যও সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘দলমত নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। যার অবস্থা খারাপ, দুস্থ, যার ঘরে খাবার নেই তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই। আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাজ করি জনগণের জন্য। কে কোন দল করলো, কে কার পক্ষে, কে আমার পক্ষে না, কে আমার ভোটার, কে আমার ভোটার না সেটা দেখার দরকার নাই। প্রশাসনের যারা কাজ করবেন তারাও এটা নজরদারিতে রাখবেন। একটি মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। আল্লাহর রহমতে প্রচুর খাবার আছে। ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেকোনো ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘মানুষের দু:খ-কষ্ট লাঘবে আমরা ত্রাণ দিচ্ছি। সেখানে কেউ থাবা বাসাক সেটা আমরা চাই না। কাজেই এরকম কোন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ দেশে এবং প্রবাসে যে যেখানেই রয়েছেন তাঁদেরকে আল্লাহ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করার আহবানও জানান শেখ হাসিনা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.