ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম

0 208

best exercise for diabetes patients

ডায়াবেটিস কি?
আমাদের শরীরে প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় নামে একটি অরগ্যান আছে যা থেকে তৈরি হয় ইনসুলিন নামের এক ধরণের হরমোন। এই হরমোনের কাজ হলো রক্তের গ্লুকোজকে শরীরের কোষে ঢুকতে সাহায্য করা। আমাদের খাবার হজমের পর বেশিরভাগ গ্লুকোজ হিসেবে রক্তের মধ্য পৌঁছে যা ইনসুলিনের উপস্থিতিতে শরীরের বিভিন্ন কোষে কোষে যায় যা আমাদের কাজ করার শক্তি যোগায়। ইনসুলিন হরমোন যদি যথেষ্ট পরিমানে তৈরি না হয় বা সঠিকভাবে কাজ না করতে পারে তাহলে রক্তের গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে পারে না ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে একদিকে কোষগুলো গ্লুকোজের অভাবে কাজ করার শক্তি হারায় আর অন্য দিকে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের সাথে বেড়িয়ে ও আসে। এ কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এবং শরীরের শক্তি হ্রাস পায়। এই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বা বহূমুত্র রোগ বলা হয়।

সাধারণত ডায়াবেটিস দুই ধরণের হতে পারে।

১) এই ধরণের ডায়াবেটিস হয় অল্প বয়সে। এখানে ইনসুলিন একদম্ ই তৈরী হয়না প্যানক্রিয়াসে। ফলে এ রোগিকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতে হয়। এরা ইনসুলিনের উপর নির্ভরশীল থাকে বিধায় এদের ডায়াবেটিস মেলিটাস ও বলা হয়ে থাকে। এই ধরণের ডায়াবেটিস আছে ৫% এর মত।

২) এ ধরণের ডায়াবেটিস এ অগ্নাশয় ইনসুলিন হরমোন তৈরী করলে ও তা যথেষ্ট হয় না এবং বিভিন্ন কারণে তা ঠিক ভাবে ও কাজ করে না। এই ধরণের ডায়াবেটিস ৯৫% পরিমাণে আছে।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হয় ঘরোয়া পদ্ধতিতে বেশিরভাগ। একমাত্র নিজে চেষ্টা করেই ডায়াবেটিস অনেক টা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

  • ব্যায়াম ও জীবন যাত্রা প্রণালীর পরিবর্তন
  • খাবার অভ্যাস পরিবর্তন ও
  • নিত্যমিত ঔষধ সেবন

ব্যায়ামঃ
রোগীর মনে প্রশ্ন হতে পারে কেন শুধু শুধু কষ্ট করে ব্যায়াম করব! সময়ের অপচয় করে কি লাভ ! তার চেয়ে একটা ট্যাবলেট গিলে ফেললেই তো হয়ে যায়। বা একটা ইনসুলিন নিলেই তো হয়। কিন্তু বাস্তবতা যে ভিন্ন। ব্যায়াম ওই ট্যাবলেট এর চেয়ে অনেক বেশি উপকারী। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিসের ফল প্রদ ঔষধ মেটফরমিনের চেয়ে ব্যায়াম রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বেশী কার্যকর ভূমিকা রাখে।

ব্যায়ামের ফলে ডায়াবেটিস রোগির শরীরের অনেক উপকার হয়। যেমনঃ-

  • ব্যায়ামে প্রচুর শক্তি খরচ হয় ফলে শরীর ফিট থাকে এবং শরীরের চর্বি কমে যায়।
  • ব্যায়ামের দ্বারা শরীরের পেঙ্ক্রিয়াসের বেটা সেল থেকে ইনসুলিন তৈরী বৃদ্ধি পায়
  • ব্যায়াম ইনসুলিনের কর্ম ক্ষমতা বাড়ায় ফলে শরীরের অল্প যা ইনসুলিন তৈরী হয় তাতেই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে বাড়তি ঔষধের দরকার না ও হতে পারে।
  • ব্যায়ামের ফলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে।
  • ডায়াবেটিসের জটিলতা কমানো সম্ভব হয়।
  • ব্যায়াম রক্তের ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টরল (LDL) কমায়।
  • ব্যায়াম উচ্চ রক্তচাপ কমায়।
  • ব্যায়াম দুশ্চিন্তা দূর করে মন কে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখে।
  • ঘুম ভালো হয়।
  • হাড় ও হৃদপিন্ডকে শক্তিশালী করে রাখে।
  • জয়েন্ট গুলো সচল রাখে।
  • বৃদ্ধ বয়সে হাড়ভাঙ্গার একটা প্রধান কারণ অস্টিওপোরসিস বা হাড় ক্ষয় হয়ে যাওয়া বিশেষ করে মহিলাদের হিপ ফ্রাকচারের ক্ষেত্রে। ব্যায়াম অস্টিওপোরসিস কমায়।
  • ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • ব্যায়াম বয়স লুকিয়ে রাখতেও সাহায্য করে। যারা সব সময় ব্যায়াম করেন তাদের কে একই বয়সের লোক থেকে কম বয়সী মনে হয়।
  • নিয়মিত ব্যায়াম যৌন ক্ষমতা অটুট রাখে।
  • ব্যায়াম ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধেও উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস দেরীতে হবে অথবা নাও হতে পারে।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ব্যায়ামঃ

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন ধরণের ব্যায়াম থাকে। যেমনঃ

  • এরোবিক ব্যায়াম
  • স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম
  • স্ট্রেচিং ব্যায়াম
  • ব্যালেন্সিং ব্যায়াম

এরোবিক ব্যায়ামঃ সাধারণভাবে ব্যায়াম বলতে যে গুলোকে বোঝায় তা হলো এরবিক ব্যায়াম। যেমনঃ- হাঁটা, দৌঁড়ানো, জগিং, বাইসাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। এই ব্যায়ামে শরীরের অনেক গুলো মাংস পেশী অনেকক্ষণ ধরে কাজ করে ফলে শক্তি ক্ষয় হয়। এই ব্যায়ামে নাড়ীর গতি শ্বাস প্রশ্বাস বাড়বে।

স্ট্রেংথেনিং ব্যায়ামঃ স্ট্রেংথ মানে হলো শক্তি। মাংসপেশীর শক্তি বাড়ানোর জন্য এই ধরণের ব্যায়াম। এ ব্যায়ামে কাজ করতে হয় বেশি যেমন ওজন তোলা বা স্প্রিং টানা ইত্যাদি।

স্ট্রেচিং ব্যায়ামঃ মাংস পেশী এবং গিঠের জড়তা কাটিয়ে সচল করাই হলো এই ব্যায়ামের উদ্দেশ্য। এরবিক ব্যায়াম শুরু করার আগে স্ট্রেচিং ব্যায়াম করা উচিত।

ব্যালান্সিং ব্যায়ামঃ ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই ব্যায়াম। যেমন এক পায়ের উপর দাঁড়ানো। এই ব্যায়াম চলাচল করতে সাহায্য করে এবং পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা করে।

ব্যায়াম করার নিয়মঃ

সপ্তাহে প্রায় অধিকাংশ সময় ( কমপক্ষে ৫ দিন ) এবং দিনে ৩০ মিনিট এরবিক ব্যায়াম করলে শরীরের জন্য সুফল বয়ে আনে। এক নাগাড়ে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে না পারলে ১০ মিনিট করে দিনে ৩ বার ব্যায়াম করলেও হবে। প্রতিদিন ৩ বার খাওয়ার আগে ১০ মিনিট করে ব্যায়াম এক টাইপের সুবিধা জনক  ব্যায়াম।

তবে ব্যায়াম শুরু করতে তো কোন সমস্যা নেই কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ব্যায়াম শুরু করার আগে শরীরে কোন রকম জটিলতা আছে কিনা তা ডাক্তার কতৃক চ্যাকাপের দরকার আছে।

প্রথমে অল্প অল্প ব্যায়াম দিয়ে শুরু করতে হবে। ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়াতে হবে। প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট করে বাড়িয়ে সপ্তাহে ১৫০-২০০ মিনিট করে ব্যায়াম করা আপনার লক্ষ্য থাকবে।

ব্যায়ামের শুরুতে কিছুক্ষণ অল্প স্বল্প ব্যায়াম করে নিবেন যেটাকে বলে “ওয়ার্ম আপ” সাথে কিছু স্ট্রেচিং ব্যায়াম এবং শেষ করার সময় ও হঠাৎ করে থেমে যাবেন না। শেষ ৫ মিনিট আস্তে আস্তে করে ব্যায়াম করা থামাবেন যেটাকে বলে কুল ডাউন।

যত বেশি ব্যায়াম করবেন তত বেশি শক্তি ক্ষয় হবে এবং গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ এ রাখা তত সহজ হবে। এরোবিক ব্যায়ামের পাশাপাশি স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম করতে হবে সপ্তাহে ২\৩ দিন। এটা হতে পারে ওজন উঠানো বা নামানো বা স্প্রিং টানা। ব্যায়াম শুরুর আগে কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। যেমনঃ-

  • কি ব্যায়াম করবেন
  • কতক্ষণ করবেন
  • কতবার করবেন
  • কখন করবেন
  • কি ধরণের পোশাক বা জুতা পড়বেন
  • ইচ্ছাকৃত ব্যায়াম না করতে পারলে অন্য কি ব্যায়াম করতে পারেন
  • কিভাবে ব্যায়াম বাড়াবেন
  • কতদূর যাবেন

তবে জেনে রাখা ভাল কখন ব্যায়াম করবেন না:
এটা আসলে নির্ভর করে আপনার দৈনন্দিন কাজের উপর। এছাড়াও রয়েছে খাবারের সময়, ডায়াবেটিসের জন্য কখন কি ঔষধ খাচ্ছেন এসবের উপর। এছাড়া ও রয়েছে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রার উপর।
১) খাওয়ার পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৩০০ মি গ্রা বা খালি পেটে ২৫০ মি গ্রা এর উপর থাকলে ব্যায়াম করবেন না।
২) খাওয়ার পর-পরি ব্যায়াম করবেন না।
৩) আমাদের মত গ্রীষ্ম প্রধান দেশে তাপমাত্রা ও মাথায় রাখার বিষয়। তাই প্রচন্ড রোদের মধ্যে ব্যায়াম করবেন না কারণ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় শরীর থেকে পানি বেরিয়ে পানি শূণ্যতা দেখা দিতে পারে সেই হিসাবে ভোরের দিকে বা সন্ধ্যার সময় ব্যায়াম করা উত্তম।

নিয়মিত ব্যায়াম করুন, সুস্থ থাকুন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.